স্বদেশ ডেস্ক:
ভারতের অযোধ্যায় বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানের মালিকানা কার, তা নিয়ে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট তাদের বহুপ্রতীক্ষিত রায় ঘোষণা করলেও সেই জমির ওপর একদা দাঁড়িয়ে থাকা বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলা কিন্তু এখনো নিম্ন আদালতে ঝুলে আছে।
সাতাশ বছর আগে বিজেপির তখনকার শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে হিন্দু করসেবকরা ওই মসজিদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সেই ঘটনায় এখনো কোনো রায়ই আসেনি।
এমনকি শুনানি শেষ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেয়া সময়সীমাও মানা যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে ভারতে এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, অযোধ্যার ওই জায়গায় রামমন্দির বানানো হলেও মসজিদ ভাঙার জন্য দোষীদের কি আদৌ কখনো সাজা হবে?
বাবরি মসজিদ ভাঙার ঠিক ১০ মাসের মাথায়, ১৯৯৩-র অক্টোবরে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল প্রভৃতি সংগঠনের ৪০ জন শীর্ষ নেতাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
তবে মসজিদ ভাঙার জন্য তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন – এই অভিযোগ থেকে ‘টেকনিক্যাল গ্রাউন্ডে’ অব্যাহতি দেয়া হয় লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলীমনোহর জোশীর মতো অনেক নেতাকেই।
দীর্ঘ ২৫ বছর পর ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট সেখানে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব আবার বহাল করে, এবং লখনৌ সেশনস কোর্টকে নির্দেশ দেয় কোনো বিরতি না-নিয়ে একটানা এই মামলার শুনানি চালিয়ে যেতে হবে।
ফলে বাবরি ভাঙায় অভিযুক্তরা যে আসলে দীর্ঘদিন আইনের নাগাল এড়াতে পেরেছেন, তা বলতে দ্বিধা নেই দিল্লিতে সিনিয়র আইনজীবী মীরা ভাটিয়ার।
মীরা ভাটিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে, আরো অনেক আগে এটা হওয়া উচিত ছিল।’
‘তবে এখন বিচার বিভাগ যে সক্রিয়তা দেখাচ্ছে, তাতে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে যে, ঝড়ের গতিতে এই মামলার শুনানি হবে এবং আমরা একটা নির্ণায়ক রায় পাব।’
লখনৌতে সেশনস কোর্ট অবশ্য সুপ্রিম কোর্টের বেঁধে দেয়া দু’বছরের ডেডলাইন মানতে পারেনি, ওই মামলার বিশেষ বিচারকের চাকরির মেয়াদও বাড়ানো হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বিবিসিকে বলছিলেন, এই মামলায় এখনো সাজার অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ঠিকই – কিন্তু বাবরি ভাঙাটা যে বিরাট এক অপরাধ সেটা ভারতের বিচার বিভাগ অনেক আগেই মেনে নিয়েছে।
তিনি বলছিলেন, “১৯৯৪-এ ইসমাইল ফারুকি মামলাতেই কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, বাবরি মসজিদ ভাঙাটা একটা ‘ন্যাশনাল সিন’, মানে জাতীয় পর্যায়ের পাপ।”
‘তখন আরো বলা হয়েছিল এখানে এমন একটা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ভিতটাকেই নড়িয়ে দিয়েছে।”
‘এমনকি গত শনিবারের রায়েও উল্লেখ করা হয়েছে, বাবরি ভাঙার মধ্যে দিয়ে আইনের শাসনের সাঙ্ঘাতিক একটা অবমাননা করা হয়েছে।’
‘এখনো এই মামলায় শাস্তি হয়নি ঠিকই, কিন্তু চার্জশিট হয়েছে। মামলাটা এখন নিম্ন আদালতে বিচারাধীনও আছে – কিন্তু ভাঙাটা কেউ কিন্তু সমর্থন করছে না, সবাই বলছে সেটা ঘোরতর অন্যায় হয়েছে।’
‘এখন ক, খ নাকি গ – কে ভেঙেছে তার ওপর সাজা হবে, কিন্তু মসজিদ ভাঙাটা যে জঘন্যতম অপরাধ সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারছে না’, বলছিলেন জাস্টিস গঙ্গোপাধ্যায়।
বস্তুত সেদিনের অপরাধটাও ছিল দুধরনের – একদল ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে কাঠামোটা ভেঙেছেন, আর নেতারা পাশের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
তবে সেই দ্বিতীয় অপরাধে অভিযুক্ত আদভানি-জোশী-উমা ভারতীর মতো বিজেপি নেতা-নেত্রীদের আজ পর্যন্ত কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি।
বছরদুয়েক আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকাকালীন উমা ভারতী তো রীতিমতো সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা করেছিলেন বাবরি ভেঙে তিনি কোনো অপরাধ করেছেন বলে মনেই করেন না।
তিনি তখন বলেছিলেন, ‘কীসের ষড়যন্ত্র? সব তো খোলাখুলি হয়েছে। মনে যা ছিল, মুখেও তা বলেছি আর কাজেও তাই করেছি।’
‘রামমন্দির আন্দোলনে অংশ নিয়ে আমি চিরকাল গর্বিত বোধ করেছি – এর জন্য আমার কোনোদিন অনুশোচনা ছিলও না, আর এর জন্য আমি কখনো ক্ষমাও চাইনি।’
এখনো উমা ভারতীর অবস্থান হল ওই মামলায় তিনি বিচারের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত।
তার সহ-অভিযুক্ত লালকৃষ্ণ আদভানি সদ্য ৯৩-এ পা দিয়েছেন, মুরলী মনোহর জোশীরও বয়স ৮৬ হতে চলল।
তাদের জীবৎকালে সুপ্রিম কোর্টে বাবরি ভাঙার মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে এমন সম্ভাবনা আসলেই খুব ক্ষীণ।
সূত্র : বিবিসি